Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

সুরা আম্বিয়ার আয়াত নং ৩০ এর তাফসির প্রসঙ্গে আলোচনা।

 

 0. সুচিপত্র :- 

 

 1. সুচনা। 

 2. আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে মুফাসসিরদের মাঝে প্রচলিত প্রধান মতামতসমুহ। 

 3. উক্ত প্রধান মতামতসমুহের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা। 

 4. অন্যান্য অপ্রধান মতামতসমুহ প্রসঙ্গে। 

 5. পরিশিষ্ট। 

 6. টিকাসমুহ। 

 

1.সুচনা :- 

 

সুরা الأنبياء (সুরা নং ২১) এর আয়াত নং ৩০ এ বলা হয়েছে যে,

 

"أولم ير الذين كفروا أنّ السماوات و الأرض كانتا رتقا ففتقناهما" 

 

অর্থ : যারা কুফরি করে তারা কি দেখেনা, যে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী একত্রে মিলিত ছিল, তারপর আমি (আল্লাহ) তাদের পৃথক করেছি। 

 

এই লেখাটিতে, উক্ত আয়াতের তাফসির সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ।

 

2.আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে মুফাসসিরদের মাঝে প্রচলিত প্রধান মতামতসমুহ:- 

 

তাফসির গ্রন্থগুলোতে অনুসন্ধান চালালে, আমরা দেখতে পাই যে আলোচ্য আয়াতের তাফসির হিসেবে মুফাসসিরদের মাঝে প্রধান তিনটি মতামত প্রচলিত আছে। নিম্নে সেই মতগুলো উল্লেখ্য করা হলো।

 

প্রথম মত :

 

আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী প্রথমে একত্রে মিলিত ছিলো, অতপর তাদেরকে আলাদা করা হয়।

 

অনেক আলেমরা আবার এই পর্যন্ত বলে থেমে যান নি, বরং কিভাবে মিলিত ছিলো ও কিভাবে আলাদা হয়েছে, সেটার কৈফিয়তও তাঁরা বর্ণনা করেছেন, যা অনেকটা এরকম,

"আকাশ পৃথিবীর পৃষ্ঠের সহিত সংযুক্ত অবস্থায় ছিলো, অতপর তাদের মাঝে বাতাস সৃষ্টি কর হয়, যার ফলস্বরুপ আকাশ উপরে উঠে যায় এবং পৃথিবীর পৃষ্ঠ হতে আলাদা হয়ে যায়।"কিছু আলেমরা এক্ষেত্রে পৃথিবীকে একটি বিস্তৃত সমতল জিনিস হিসেবে কল্পনা করেছেন। এবং কিছু আলেমরা এমনভাবে বিষয়টা বর্ণনা করেছেন যে এরজন্য পৃথিবীর সমতল হয়া জরুরি নয়। 

 

দ্বিতীয় মত : 

 

আকাশ প্রথমে একটা ছিলো, অতপর তা হতে সাত আসমানকে পৃথক করাপুর্বক নির্গত করা হয়। একইভাবে পৃথিবীও প্রথমে একটা ছিলো, অতপর তা হতে সাত পৃথিবীকে নির্গত কর হয়।

 

তৃতীয় মত : 

 

আকাশ প্রথমে বন্ধ ছিলো, তাতে কোনো মেঘ ছিলোনা, বৃষ্টি হতোনা। একইভাবে পৃথিবীও বন্ধ ছিলো, তাতে কোনো গাছপালা হতোনা। অতপর আকাশকে মুক্ত করা হয় বা খোলে দেয়া হয় বৃষ্টিপাত ঘটানোর দ্বারা, এবং পৃথিবীকে খোলে দেয়া হয় গাছপালা জন্মানোর দ্বারা। 

 

 3. উক্ত প্রধান মতামতসমুহের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা :- 

 

এই অংশে, দ্বিতীয় অংশে উল্লেখিত মতামতগুলোর ব্যাপারে পর্যায়ক্রমে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

 

প্রথম মত প্রসঙ্গে : 

 

আকাশ ও পৃথিবী মিলিত ছিলো, অতপর তাদের আলাদা করা হয়, এই মতটিতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্ত এক্ষেত্রে যে কৈফিয়তটা দেয়া হয়েছে সেই কৈফিয়তটা সমস্যাযুক্ত।

 

অর্থাৎ, সমতল পৃথিবীর অথবা গোল পৃথিবীর পৃষ্ঠের সহিত আকাশ যুক্ত ছিলো, অতপর তাদের মাঝখানে বায়ু তৈরি করা হয়, যার ফলস্বরুপ আকাশ উপরে উঠে যায় এবং আকাশ ও পৃথিবী আলাদা হয়ে যায় ; এই যে কৈফিয়তটা তথা কিভাবে যুক্ত ছিলো ও আলাদা হয়েছে সেসক্রান্ত বর্ণনাটা, এটা সমস্যাযুক্ত।এখানে যেই সমস্যাটা আছে, তা হচ্ছে এই যে, উক্ত কৈফিয়তটি ইসরাইলি উৎস হতে মুসলিম মুফাসসিরদের মাঝে প্রবেশ করেছে। তথা উক্ত কৈফিয়তটি ইসরাইলি উৎস হতে নেয়া। 

 

আছ-ছা'লাবী, আল-বাগভী, ফাখরুদ্দিন, আল-কুরতুবি, আল-খাযিন, আল-ওয়াহিদী,আবু হাইয়ান, ছানাউল্লাহ, আবুস-সউদ, আশ-শিরবিনী সহ অন্যান্য বহু আলেমরা উল্লেখ্য করেছেন যে 'কাব আল-আহবার' বলেছেন, 

  

خلق الله السموات وَالْأَرْضَ بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ ثُمَّ خَلَقَ رِيحًا بوسطها  ففتحها بها_[1] 

 

অর্থ : আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেন এই অবস্থায় যে আকাশ পৃথিবীর উপর লেগে ছিলো, অতপর তাদের মধ্যস্থলে বাতাস সৃষ্টি করেন যার ফলস্বরুপ তারা পরস্পর হতে আলাদা হয়ে যায়।

 

দেখা যাচ্ছে যে উক্ত কৈফিয়তটি কাব আল-আহবার হতেও বর্ণিত হয়েছে।

 

প্রকৃতপক্ষে কাব আল-আহবার হতে উক্ত বক্তব্যটি কোনো সহিহ বা হাসান সনদে প্রমাণিত নয়। কিন্ত এক্ষেত্রে অন্যান্য এমন কিছু বিষয় আছে যা এব্যাপারটাকে সত্যায়ন করে যে উক্ত বক্তব্যটি কাব আল-আহবার অথবা উনার অনুরূপ কোনো ইসরাইলি তথ্যের পন্ডিত কর্তৃক প্রদানকৃত।

 

প্রসিদ্ধ তাবেঈ 'আল-হাসান আল-বসরী' এবং 'কাতাদাহ বিন দায়ামাহ' হতে সহিহ সনদে এমনটা প্রমাণিত আছে যে তারা আলোচ্য আয়াতের তাফসির হিসেবে উক্ত কৈফিয়তটি বর্ণনা করেছেন। [2] অনুরূপভাবে তাবে তাবেঈ মুফাসসির 'ইয়াহইয়া ইবনু সাল্লাম' তাঁর তাফসিরগ্রন্থে আলোচ্য আয়াতের তাফসির হিসেবে উক্ত কৈফিয়তটি বর্ণনা করেছেন। [3]

 

আল-হাসান, কাতাদাহ, ইবনু সাল্লাম, এই তিনজন উলামার মধ্যেই একটা বিষয় সাধারণ, আর তা হচ্ছে এই যে, এনারা সবাই প্রায়সময়ই ইসরাইলি উৎস হতে বিভিন্ন তথ্য গ্রহণ করে সেগুলো বর্ণনা করতেন, ইসরাইলি উৎস হতে বিভিন্ন তথ্য বর্ণনা করাটা এনাদের অভ্যাস ছিলো।আল-হাসান আল-বসরী তো সেসব আলেমদের অন্তর্ভুক্ত একজন যারা কিনা সবচেয়ে বেশিমাত্রায় সর্বাধিক পরিমাণ বিপুল সংখ্যাক ইসরাইলি তথ্য বর্ণনা করেছেন, যারা কিনা অত্যাধিক পরিমাণ ইসরাইলি তথ্য গ্রহণ ও বর্ণনা করার কারণে এরজন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কাতাদাহও অনেক ইসরাইলি তথ্য বর্ণনা করেছেন। ইবনু সাল্লামও প্রচুর পরিমাণ ইসরাইলি তথ্য বর্ণনা করেছেন। এনাদের প্রত্যেকেই ইসরাইলি উৎস দ্বারা কমবেশী প্রভাবিত ছিলেন, এনাদের মধ্যে ইসরাইলি উৎস দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন আল-হাসান আল-বসরী।

 

অপরদিকে, মুকাতিল ইবনু সুলাইমান ও এক্ষেত্রে আলোচ্য কৈফিয়তটির অনুরুপ কৈফিয়ত বর্ণনা করেছেন [4]। মুকাতিল ইবনু সুলাইমান এমন একজন মুফাসসির ছিলেন, যিনি কিনা ইহুদি খ্রিষ্টানদের নিকট হতে তথা ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে কোরআনের জ্ঞান নিতেন। [5] সুতরাং আলোচ্য কৈফিয়তটিও তিনি ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতেই নিয়েছেন।

 

সবমিলিয়ে বলা যায় যে, আলোচ্য কৈফিয়তটি ইসরাইলি উৎস হতেই গ্রহণকৃত। 

 

মুহাক্কিক ডক্টর 'আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আযিয বিন মুহাম্মদ আল-মাদিমিগ' আলোচ্য কৈফিয়তটির ব্যাপারে বলেছেন যে, 

"وهو من الإسرائيليات"_[6] 

 

অর্থ : "এবং এটা ইসরাঈলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত" 

 

তাছারা সমতল পৃথিবীর ধারনাও মুসলিমদের মাঝে ইসরাইলি উৎস হতে এসেছে, 

 

মুকাতিল ইবনু সুলাইমান তাঁর তাফসিরে লিখেছেন,

 

بَسَط الأرضَ مِن تحت الكعبة، فبسطها بعد الكعبة بقدر ألفي سنة، فجعل طولها مسيرة خمسمائة عام

[7] 

 

অর্থ : পৃথিবীকে কাবার নিচ থেকে বিস্তৃত করেছেন, এবং বাদ কাবা পৃথিবীকে এক হাজার বছর যাবত বিস্তৃত করেছেন, এবং পৃথিবীর বিস্তৃতীকে পাঁচশত বছরের পথ করেছেন।

 

মুকাতিলের উল্লেখিত উক্ত তথ্যটিতে সমতল পৃথিবীর ধারনা উহ্য আছে, এটি এমন একটি তথ্য যা কিনা ইজতিহাদ ও মেধা ব্যবহার করে জানা তখন সম্ভব ছিলোনা, এবং মুকাতিল কোরানের ইলম নিতেন ইসরাইলি উৎস থেকে। সুতরাং উক্ত তথ্যটি ইসরাইলি, সুতরাং উক্ত তথ্যটিতে উহ্যভাবে বিদ্যমান সমতল পৃথিবীর ধারনাও ইসরাইলি উৎস হতেই আগত। 

 

আলোচ্য আয়াতের ব্যাপারে অনেকে দাবি করে যে, পৃথিবী ও আকাশ নাকি সৃষ্ট অবস্থাতেই পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিলো, অতঃপর ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়ে যাওয়া এই আকাশ ও পৃথিবীকে পরস্পর হতে আলাদা করা হয়।

 

এই দাবিটি ভুল। কেননা, আলোচ্য আয়াতে আকাশ ও পৃথিবীর একদম শুরুর দিকের "আদি অবস্থা" এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে [8]। অতএব, তখনো আকাশ বা পৃথিবী সৃষ্টি হয়নি, বরং তখন তাদের আদি রূপগুলো বা অবস্থাগুলো বিদ্যমান ছিলো ও পরস্পরের সহিত যুক্ত ছিলো। সেই আদি অবস্থা প্রকৃতপক্ষে কেমন ছিলো তা ইলমুল-গায়েবের বিষয়। 

 

আসলে উক্ত দাবিটির উৎস হচ্ছে আলোচ্য মতটির সহিত বর্ণিত কৈফিয়তটি। উক্ত কৈফিয়তটিতে ধরে নেয়া হয়েছে যে আকাশ ও পৃথিবী আগে থেকেই সৃষ্ট ছিলো এবং একে অপরের সাথে যুক্ত ছিলো, অতপর আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে বাতাস সৃষ্টি করা হলে আকাশ উপরে উঠে যায়, এবং এভাবেই আকাশ ও পৃথিবী আলাদা হয়। কিন্ত উক্ত কৈফিয়তটি ইসরাইলি উৎস হতে গ্রহণকৃত হয়ার দরুন নির্ভরযোগ্য নয়, এর ইসরাইলি হয়ার ব্যাপারে ইতিমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই দাবিটি প্রকৃতপক্ষে ইসরাইলি উৎস দ্বারা প্রভাবিত।

 

আলোচ্য মতটি দ্বারা আলোচ্য আয়াতটিকে ইবনু কাসির তাফসির করেছেন। ইবনু কাসিরের করা উক্ত তাফসিরের আলোকে আলোচ্য আয়াতটির তাফসির নিম্নে উল্লেখ্য করা হলো।…[8] 

 

এক্ষেত্রে "আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী" বলতে উদ্দেশ্য সমগ্র মাখলুকাত বা সকল সৃষ্টি, অর্থাৎ সমগ্র মহাবিশ্ব এবং তাতে বিদ্যমান সমস্তকিছু। এটা একটা যৌক্তিক তাফসির, কেননা আকাশমন্ডলী বলতে এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য পৃথিবী ব্যাতিত অন্যান্য সবকিছু, এবং পৃথিবী বলতে উদ্দেশ্য পৃথিবী, এবার পৃথিবী ব্যাতিত বাকি সবকিছু আর পৃথিবী মিলে হয় সমগ্র মহাবিশ্ব এবং তাতে বিদ্যমান সমস্তকিছু।"আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী একত্রে মিলিত ছিলো", এর মানে হচ্ছে এই যে সকল সৃষ্টি বা সবকিছু তাদের "আদি অবস্থায়" বা "আদি রূপে" একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত ছিলো, পরস্পর সংলগ্ন ছিলো, স্তূপীকৃত তথা স্তূপ আকারে ছিলো, একটার উপর আরেকটা লেগে ছিলো, অতপর সবকিছুকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, সাত আসমান ও সাত পৃথিবী তৈরি করা হয়, নিকটবর্তী আকাশের স্তর ও পৃথিবীর মাঝে বাতাস দ্বারা ব্যবধান দেয়া হয়। 

 

তাফসির সমাপ্ত।

 

দ্বিতীয় মত প্রসঙ্গে : 

 

এই মত অনুযায়ী আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মিলিত থাকা ও পরে আলাদা হয়ার ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে,

 

"প্রথমে শুধু একটা আসমান ছিলো, অতপর সেই একটা আসমানকে সাত আসমানে পরিণত করা হয়, একইভাবে প্রথমে শুধু একটা পৃথিবী ছিলো অতপর সেই একটা পৃথিবীকে সাত পৃথিবীতে পরিণত করা হয়। " 

 

এই মত অনুযায়ী বিচার করলে, আলোচ্য আয়াতে মোটেও এটা বোঝানো হয়নি যে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরস্পরের সহিত যুক্ত ছিলো, বরং এখানে নিছকই এক আসমান থেকে সাত আসমান ও এক পৃথিবী থেকে সাত পৃথিবী হয়ার ব্যাপারটি বর্ণিত হয়েছে।

 

এই মত প্রদানকারী মুফাসসিরদের অন্তর্ভুক্ত একজন 'মুজাহিদ বিন জাবার' উক্ত মতটি ব্যাক্ত করাপুর্বক বলেছেন যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরস্পরকে কখনোও স্পর্শ করেনি [9], এবং উক্ত বক্তব্যটি প্রথম মতটির ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়া কৈফিয়তটিকে ভুল সাব্যস্ত করে। 

 

উল্লেখ্য, সাত পৃথিবীর অবস্থা কেমন, তা কোথায় কিভাবে অবস্থান করছে এনিয়ে আলেমদের মাঝে মতভেদ আছে। জুমহুর উলামাদের মতে আমরা যেই ভুপৃষ্ঠে বাস করছি সেই ভুপৃষ্ঠের নিচেই স্তরে স্তরে আরো মোট ছয়টি পৃথিবী আছে। অনেকে ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব বলে, বাস্তবতাবিরোধী বলে।

 

কিন্ত প্রকৃতপক্ষে এটা বিজ্ঞানবিরোধী নয়, বাস্তবতাবিরোধী নয়। কেননা বাকি ছয় পৃথিবী কিভাবে কোন অবস্থাতে কোন পদ্ধতিতে আমাদের ভুপৃষ্ঠের নিচে অবস্থান করছে তা গায়েবসক্রান্ত বিষয়, কাজেই এমনটাও হয়া সম্ভব যে এই বাকি ছয় পৃথিবী এমন কোনো এক অজানা, বিশেষ ও গায়েবী অবস্থায় বা পদ্ধতিতে আমাদের এই ভুপৃষ্ঠের নিচে অবস্থান করছে যে আমাদের পক্ষে এই ভুপৃষ্ঠে বসে চিন্তাশক্তি, কান্ডজ্ঞান, মেধা এবং বিজ্ঞান ব্যবহার করে এগুলোকে নির্ণয় বা চিহ্নিত করা সম্ভব না, দেখতে পারা বা আবিষ্কার করা সম্ভব না।  যেহেতু বাকি ছয় পৃথিবী কিভাবে কোন অবস্থায় বা পদ্ধতিতে আমাদের ভুপৃষ্ঠের নিচে আছে তা ইলমুল-গায়েব সক্রান্ত বিষয়, সেহেতু এই ব্যাপারটা মানব মস্তিস্কের চিন্তাশক্তি, মেধা ও কান্ডজ্ঞানের উর্দ্ধের বিষয়, বিজ্ঞানের নাগালের বাহিরের বিষয়, মানুষের মস্তিস্কের পক্ষে এবং বিজ্ঞানের পক্ষে তা বোঝে উঠা সম্ভব না। 

 

ভুমির সমগ্র তলদেশে যদি কোনোভাবে খোজ চালানো হয়, তাহলে মোটেও এই বাকি ছয় পৃথবীর সন্ধান পাওয়া যাবেনা, বরং নিছকই মাটি, বিভিন্ন জ্বীবাশ্ন জ্বালানি, বিভিন্ন খানিজ পদার্থ, পানি, লার্ভা ইত্যাদি এজাতীয় জিনিসপত্রই পাওয়া যাবে। এরমানে এইনা যে মাটির নিচে এই ছয় পৃথিবী নেই, বরং অবশ্যই আছে, কিন্ত সেগুলো কোনো এক অজানা গায়েবী অবস্থায় বা পদ্ধতিতে বিদ্যমান আছে, যার ফলস্বরুপ মাটির নিচে যতই খোজ করা হোক না কেন, এই বাকি ছয় পৃথিবীকে খোজে পাওয়া যাবেনা।

 

তৃতীয় মত প্রসঙ্গে : 

 

এই মত অনুযায়ী আলোচ্য আয়াতটির ব্যাখ্যা নিম্নরুপ,

 

"আকাশ বন্ধ ছিলো, পৃথিবীও বন্ধ ছিলো, আকাশ বন্ধ থাকার অর্থ হলো এই যে বৃষ্টি হতোনা, পৃথিবী বন্ধ থাকার অর্থ হলো এই যে তাতে গাছ-পালা জন্মাতো না, অতপর আকাশকে খোলা হয়, পৃথিবীকেও খোলা হয়। আকাশকে খোলার অর্থ হলো বৃষ্টিপাত ঘটানো, পৃথিবীকে খোলার অর্থ হলো তাতে গাছপালা জন্মানো। " 

 

এই মতটি অত্যন্ত সরল, উক্ত মত অনুযায়ী বিচার করলে, আলোচ্য আয়াতে নিছকই এটা বোঝানো হচ্ছে যে আগে বৃষ্টি হতোনা, গাছপালা জন্মাতো না, অতপর বৃষ্টি হয় ও গাছপালা জন্মায়।

 

 4. অন্যান্য অপ্রধান মতামতসমুহ প্রসঙ্গে :- 

 

আলোচ্য প্রধান মতামতগুলো ছাড়াও আলোচ্য আয়াতটির ব্যাখ্যা হিসেবে আরো বিপুল সংখ্যাক ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা ও মতামত প্রচলিত আছে, তবে সেগুলো মুফাসসিরদের মাঝে খুব একটা প্রচলিত না, অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতামত না, বরং সামান্য কিছু আলেমরাই আলোচ্য আয়াতের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের অপ্রধান ব্যাখ্যা বা মতামত ব্যাক্ত করেছেন।

 

তাছারা আলোচ্য তিনটি প্রধান মতেরও আবার কিছুসংখ্যাক হালকা পরিবর্তিত বা অতিরিক্ত সংযুক্তিবিশিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা সংস্করণ আছে,  তবে এই ধরনের মতামতগুলোতে বিদ্যমান পরিবর্তনের ফলাফল বা অতিরিক্ত সংযুক্তিগুলো মুফাসসিরদের মাঝে তেমন প্রচলিত না। 

 

অনেকে আবার আলোচ্য আয়াতের ব্যাপারে দাবি করে যে আলোচ্য আয়াতে নাকি মহাবিস্ফোরণতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে, এই দাবিটা সমস্যাজনক। কেননা এমনটা শতভাগ নিশ্চয়তার সহিত বলা যায়না যে আলোচ্য আয়াতে মহাবিস্ফোরণতত্ত্বের কথাই বলা হয়েছে। 

 

 5. পরিশিষ্ট :- 

 

সুরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গেলে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিতে ভোগে, বোঝতে ভুল করে। আর তাই, আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যাসমুহের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করে এই লেখাটা লেখেছি, যাতে করে এই আয়াতটির ব্যাখ্যা নিয়ে ভুল বোঝাবোঝি ও বিভ্রান্তি না ঘটে।

 

 

6.টিকাসমুহ :- 

 

[1]আছ-ছা'লাবী, আল-কাশফু ওয়াল বায়ান (18/118);তাফসিরুল বাগভী (5/316);

তাফসিরুর রাযী (22/162);তাফসিরুল কুরতুবী (11/283); তাফসিরুল খাযিন (3/293); আও-ওয়াহিদী, আত-তাফসিরুল বাসিত (15/58);আবু হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহিত (7/424) ;আত-তাফসিরুল মাযহারী (6/193); তাফসিরু আবিস-সউদ (6/64); আশ-শিরবিনী, আস-সিরাজুল মুনির (2/503)। 

 

[2]আত-তাবারী, জামিউল বায়ান (16/256)

 

[3]তাফসিরু ইয়াহইয়া বিন সাল্লাম (1/308)

 

[4]তাফসিরু মুকাতিল ইবনু সুলাইমান (3/76)

 

[5]ইবনু হিব্বান, কিতাবুল মাজরুহিন (3/14)

 

[6]আত-তাফসিরুল বাসিত (15/58 -টিকা নং 4)

 

[7]তাফসিরু মুকাতিল ইবনু সুলাইমান (2/366)

 

[8]তাফসিরু ইবনে কাসির (9/399) 

 

[9]আবুশ-শায়খ, আল-আযমাহ (3/1026)

 

[10]তাফসিরুস সাদী (পৃ/522)