বিষয় : আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার ও এক আকাশ হতে আরেক আকাশের মধ্যকার দূরত্ব ৫০০ বছরের পথ হওয়া প্রসঙ্গে।
লেখক : সামিউল হাসান তবিব আল-ইনফিরাদী
0. সূচিপত্র :-
1. ভূমিকা।
2. প্রমাণসমূহ।
3. প্রমাণসমূহের পর্যালোচনা :-
3.1. প্রথম প্রমাণ প্রসঙ্গে।
3.2. দ্বিতীয় প্রমাণ প্রসঙ্গে।
3.3. তৃতীয় প্রমাণ প্রসঙ্গে।
4. উপসংহার।
5. টীকাসমূহ।
1.ভূমিকা :-
আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ এবং সাত আকাশের ক্ষেত্রে এক আকাশ হতে আরেক আকাশের মধ্যবর্তী দূরত্বও পাঁচশত বছরের পথ, এইমর্মের বিভিন্ন কথা ও বিশ্বাস মুসলিমদের মাঝে প্রচলিত ছিল ও আছে।
2.প্রমাণসমূহ :-
আমার অনুসন্ধানে, আমি উক্ত দাবিটির সমর্থনে মোট তিনটি প্রমাণ পেয়েছি, যথা :-
এক. মুহাম্মাদ ﷺ হতে বর্ণিত বেশকিছু হাদিস।
দুই . ইবনু মাসউদ (রা:) হতে মাওক্বুফরূপে বর্ণিত একটি বর্ণনা।
তিন. মুহাম্মাদ ﷺ হতে বর্ণিত একটি বিশেষ হাদিস।
3. প্রমাণসমূহের পর্যালোচনা :-
এই লেখাটিতে, উক্ত প্রমাণত্রয়ের প্রত্যেকটা নিয়েই আলোচনা হবে, ইনশাআল্লাহ।
3.1. প্রথম প্রমাণ প্রসঙ্গে :-
দাবিটির সমর্থনে মুহাম্মাদ ﷺ হতে কিছু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এসব হাদিস উক্ত দাবিটির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য না। কারণ, উক্ত হাদিসগুলোর সবগুলোই অতিমাত্রায় দূর্বল।_[1]
3.2. দ্বিতীয় প্রমাণ প্রসঙ্গে :-
ইবনু মাসউদ (রা) হতে মাওক্বুফরূপে বর্ণিত বর্ণনাটি নিম্নরূপ।_[2]
عن ابن مسعود رضي اللّٰه عنه قال بين السماء الدنيا و التي تليها خمسمائة عام و بين كل سماء مسيرة خمسمائة عام و غلظ كل سماء مسيرة خمسمائة و بين السماء السابعة و بين الكرسي خمسمائة عام و بين الكرسي و بين الماء خمسمائة عام و العرش فوق الماء و اللّٰه فوق العرش و لا يخفی عليه شيء من أعمالكم
অর্থ : ইবনু মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন যে, নিকটবর্তী আকাশ ও তার নিচের (তথা পৃথিবীর) মধ্যকার দুরত্ব হচ্ছে পাঁচশত বছরের পথ। এবং প্রত্যেক আকাশের মধ্যবর্তী দুরত্ব হচ্ছে পাঁচশত বছরের পথ। এবং প্রত্যেক আসমানের পুরুত্ব পাঁচশত বছরের পথ। এবং সপ্তম আসমান ও কুরসীর মধ্যকার দুরত্ব পাঁচশত বছরের পথ। এবং কুরসী ও পানির মধ্যকার দুরত্ব পাঁচশত বছরের পথ। এবং আরশ পানির উপরে আছে, এবং আল্লাহ আরশের উপরে আছেন, এবং তোমাদের কোনোকিছুর তাঁর নিকট গোপন নয়।
উক্ত বর্ণনাটির সনদ "হাসান" । তাছাড়া, এই বর্ণনাটি একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং এর মতনেরও একাধিক রূপ বিদ্যমান।
একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পার করতে কত সময় লাগবে তা নির্ভর করে কোন গতিতে চলন সংঘটিত হচ্ছে তার উপর, একেক গতিতে একই দূরত্ব অতিক্রম করতে ভিন্ন ভিন্ন সময় লাগবে। তো এখন প্রশ্ন হলো এই যে, ইবনু মাসউদ (রা) এর উক্ত বিবৃতিটিতে কীসের বা কোন গতির সাপেক্ষে পাঁচশত বছর বলা হয়েছে?
অনেকে, এমনকি কিছু আলেমরাও, মনে করেন যে এই পাঁচশত বছরের পথ বলতে উদ্দেশ্য ভুপৃষ্ঠে মানুষের গতিতে অথবা পৃথিবীতে বসবাসকারী কোনো প্রাণীর গতিতে টানা পাঁচশত বছর চললে যেই পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রান্ত হবে তার সমপরিমাণ একটি দূরত্ব বা ব্যবধান। তবে এটা নিছকই একটা সম্ভাবনা, হাদিসে যে এটাই উদ্দেশ্য, তা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই এবং ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।
কোন গতির সাপেক্ষে যে এই পাঁচশত বছর, তা নিশ্চিতভাবে জানা অসম্ভব এবং অজানা।
অতএব, এই পাঁচশত বছর এর পথ বলতে কী পরিমাণ দূরত্ব উদ্দেশ্য তা জানা অসম্ভব।
ইমাম আহমাদ (রহ:) এর মতে, এই পাঁচশত বছর হচ্ছে জিব্রাইল (আ:) এর গতির সাপেক্ষে। অর্থাৎ জিব্রাইল (আ:) তাঁর নিজ গতিতে চললে উক্ত পাঁচশত বছরের পথের দূরত্ব অতিক্রমে তাঁর পাঁচশত বছর সময় লাগে। _[3] অপরদিকে, জিব্রাইল (আ:) এর গতি কী সেটাও অজানা।
ইমাম আহমাদ (রহ:) এর উক্ত মতটির বিরুদ্ধে এইমর্মে আপত্তি আসতে পারে যে, জিব্রাইল (আ:) তো মুহুর্তেই মধ্যেই পৃথিবী থেকে আকাশে এবং এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে আসা যাওয়া করতে সক্ষম! উনার পাঁচশত বছর সময় লাগবে, এটাতো কোরআন সুন্নাহর সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ!
উক্ত আপত্তিটির জবাবে বলব যে, এক্ষেত্রে ইমাম আহমাদের মতটির বিবৃতিটি পরোক্ষভাবে এই ব্যাখ্যাটির দিকে ইংগিত করে যে এই পাঁচশত বছর সময়টা অতিক্রান্ত হয় কেবলমাত্র জিব্রাইল (আ:) এর জন্য তাঁর নিজ দৃষ্টিকোণ এর সাপেক্ষে, পৃথিবীবাসীর জন্য নয়, পৃথিবীবাসীর দৃষ্টিকোণ হতে বিচার করলে জিব্রাইল (আ:) মুহুর্তের মধ্যেই এসব করতে সক্ষম।
উল্লেখযোগ্য যে, জিব্রাইল (আ:) নিজে এবং তাঁর গতির ধরন-প্রকৃতি বস্তুজগতের বহির্ভূত ব্যাপার-স্যাপার, অতএব বস্তুজগতের জন্য প্রযোজ্য নিয়ম-কানুন জিব্রাইল (আ:) এবং তাঁর গতির ধরন-প্রকৃতি এর বেলায় অপ্রযোজ্য।
3.3. তৃতীয় প্রমাণ প্রসঙ্গে :-
বিশেষ হাদিসটি নিম্নরূপ,_[4]
عن عيسى بن هلال الصدفي، عن عبد الله بن عَمرو بن العاص، قال: قال رسول الله صَلى الله عَليه وسَلم:
لو أن رصاصة مثل هذه، وأشار إلى مثل جمجمة، أرسلت من السماء إلى الأرض، وهي مسيرة خمس مئة سنة، لبلغت الأرض قبل الليل، ولو أنها أرسلت من رأس السلسلة، لسارت أربعين خريفا، الليل والنهار، قبل أن تبلغ أصلها، أو قعرها
অর্থ : আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মাথার খুলীর দিকে ইশারা করে বলেছেনঃ এটার মতই একটি সীসা যদি আকাশ হতে যমিনের দিকে ছেড়ে দেয়া হয় তবে রাত হওয়ার পূর্বেই তা পৃথিবীতে পৌছে যাবে। অথচ এতদুভয়ের মাঝখানে পাঁচ শত বছরের পথের ব্যবধান রয়েছে। আর জাহান্নামের জিঞ্জীরের অগ্রভাগ হতে সীসাটি নীচের দিকে নিক্ষেপ করা হলে তা চল্লিশ বছর ধরে রাত-দিন চলতে থাকবে, গর্তের শেষ সীমায় পৌছার পূর্ব পর্যন্ত।
(অনুবাদ hadithbd.com থেকে নেওয়া)
এই হাদিসটির নির্ভরযোগ্যতা প্রসঙ্গে মতভেদ আছে। কিছু আলেম এটাকে যইফ সাব্যস্ত করেছেন। তবে অধিকাংশ আলেমদের মতে এটি সহিহ বা হাসান।
উক্ত হাদিসটি দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে আকাশ ও ভূপৃষ্ঠের মধ্যকার দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ। কারণ এক্ষেত্রে একটা যথার্থ সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, উক্ত হাদিসটিতে আকাশ বলতে মহাশুণ্যের সীমানা উদ্দেশ্য নয় বরং ভূপৃষ্ঠ হতে কোনো এক হিসেবে ৫০০ বছরের পথের দূরত্বে বিদ্যমান মহাশুণ্যের একটি অঞ্চল বা অংশ উদ্দেশ্য।
এখন প্রশ্ন হলো এই যে, সীসাটিকে যদি ৫০০ বছরের দূরত্ব থেকে ছাড়া হয়, তাহলে তা কিভাবে রাত হওয়ার পূর্বেই পৃথিবীতে আসতে পারবে? এত কম সময়ে সীসাটি কর্তৃক এত বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারার তো কথা না!
এর উত্তরস্বরূপ বলব যে,
হাদিসটির "তবে রাত হওয়ার পূর্বেই তা পৃথিবীতে পৌছে যাবে" অংশটির একটি যথার্থ সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, উক্ত অংশটি দ্বারা আক্ষরিকার্থেই "রাত হওয়ার আগে" উদ্দেশ্য না। বরং এখানে "রাত হওয়ার আগে" বলতে বুঝানো হচ্ছে যে সীসাটি একটি অনির্দিষ্টকৃত অল্প পরিমাণ সময়কাল পর ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসবে। [5]
কিন্তু তবুও, সীসাটি কর্তৃক পৃথিবীতে আসতে যে সময় লাগবে সে সময়টিকে "অল্প" বলা তো মানানসই না! সময়টা কিভাবে কোন যুক্তিতে "অল্প" হতে পারে?
এর উত্তরস্বরূপ বলব যে,
সীসাটি কর্তৃক জিঞ্জীরটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌছাতে যেই সময় লাগবে, সেই সময়টির তুলনায় সীসাটি কর্তৃক ভূপৃষ্ঠে এসে পৌছানোর সময়টি অতিশয় নগণ্য ও অতিঅল্প। এটাই হচ্ছে আলোচনাধীন হাদিসটির মূল বার্তা। অতএব, এক্ষেত্রে এটা সম্পূর্ণরূপে সম্ভাব্য যে এখানে অল্প হওয়ার বিষয়টি প্রযোজ্য "তুলনামূলকভাবে" অর্থাৎ একটা তুলনা নির্দেশক হিসেবে।
হাদিসটিতে বলা হয়েছে যে, সীসাটি কর্তৃক জিঞ্জীরটির একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌছাতে 40 বছর সময় লাগবে। তাহলে এর মানে কি এই যে, সীসাটি কর্তৃক পৃথিবীতে পৌছাতে যেই সময় লাগবে তা 40 বছরের চেয়ে কম?
এ প্রসঙ্গে বলব যে,
হাদিসটিতে উল্লেখকৃত জিঞ্জীরটি জাহান্নামে অবস্থিত। হাদিসটিতে বলা হয়েছে যে, জিঞ্জীরটির এক প্রান্ত থেকে সীসাটিকে ছেড়ে দিলে সীসাটি রাত-দিন বিরতিহীনভাবে 40 বছর যাবত ভ্রমণ করে জিঞ্জীরটির অপর প্রান্তে পৌছাবে।
সীসাটি কর্তৃক জিঞ্জীরটির একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত যেতে যে সময় লাগবে তা বর্ণনা করার জন্য হাদিসটিতে একদম সুস্পষ্টভাবে রাত এবং দিন এর কথা আনা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে সীসাটি রাত-দিন বিরতিহীনভাবে ভ্রমণ করবে। এই রাত এবং দিন বলতে জাহান্নামের রাত-দিন উদ্দেশ্য, কারণ জিঞ্জীরটি জাহান্নামে অবস্থিত।
জাহান্নামের রাত-দিনের হিসাব ও দৈর্ঘ্য কেমন, এনিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও মত প্রচলিত থাকলেও এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তার সহিত কিছু বলা যায় না । এ প্রসঙ্গে কেবল এতটুকু বলা যায় যে, জাহান্নামীয় দিনের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘের চেয়ে অনেক বেশি।
5. টীকাসমূহ :-
[1] https://islamqa.info/ar/225192
[2]
رواه الدارمي في الرد على الجهمية (دار ابن كثير،ص٥٥) وابن خزيمة في التوحيد (دار الكتب العلمية، ص١٠٥ - ١٠٦) والطبراني في الكبير (مكتبة العلوم و الحكم ،٩/ ٢٠٢) وأبو الشيخ في العظمة (دار العاصمة ،٢/ ٥٦٥، ٦٨٩) وابن بطة في الإبانة (دار الراية،٣/ ١٧١) واللالكائي في شرح أصول إعتقاد أهل السنة (دار طيبة،٣/ ٣٩٥) وابن عبد البر في التمهيد (وزارة عموم الأوقفاف،٧/ ١٣٩) البيهقي في الأسماء والصفات (دار الكتب العلمية ،ص٥٠٧)
[3]
قال الإمام أحمد بن حنبل في الرد علی الجهمية و الزنادقة (دار الثبات ،صفحة 70)
وأما قوله: {يُدَبِّرُ الأَمْرَ مِنْ السَّمَاءِ إِلَى الأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ} [السجدة: ٥] وذلك أن جبرائيل كان ينزل على النبي -صلى الله عليه وسلم- ويصعد إلى السماء في يوم كان مقداره ألف سنة، ذلك أنه من السماء إلى الأرض مسيرة خمسمائة عام، فهبوط خمسمائة، وصعود خمسمائة عام، فذلك ألف عام
[4]
المسند المصنف المعلل (دار الغرب الإسلامي ، 17/535)
[5]
قال عبد الحق الدهلوي في لمعات التنقيح (دار النوادر ، 9/160) :
وقوله: (لبلغت الأرض قبل الليل) لعل المراد به مدة قليلة، لا التعيين والتحديد
******